সিন্ধু সভ্যতা
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সিন্ধু সভ্যতা (সিন্ধ) (সিন্ধি: سنڌ , উর্দূ: سندھ, হিন্দি: सिन्ध} একটি প্রাচীন সভ্যতা যা সিন্ধু নদীর উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল।
সূচিপত্র |
[সম্পাদনা] সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ
পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবে সাহিওয়াল জেলায় অবস্থিত হরপ্পা দীর্ঘকাল যাবৎ রবি নদীর তীরবর্তী তার বিস্তৃত এলাকার কারণে প্রত্নবিদদের অত্যন্ত পরিচিত ছিলো। কিন্তু ১৯২২ সালে রাখাল দাস ব্যানার্জী সিন্ধের লারখানা জেলায়, সিন্ধু নদের তীরভূমির নিকটে মহেঞ্জোদড়ো আবিষ্কার করার পূর্বে, মহান এক প্রাচীন সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে হরপ্পার প্রকৃত তাৎপর্য সকলের অজ্ঞাত, অস্বীকৃত ছিলো। [১] আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তদানীন্তন প্রধান অধিকর্তা স্যার জন মার্শাল হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদড়োর আবিস্কৃত সংস্কৃতির পরিচয়ে সিন্ধু সভ্যতা নামকরণ করেন। দুদিক থেকেই নামটি সুপ্রযুক্ত। কেননা, সিন্ধু নামের মধ্যে এর ভৌগলিক অবস্থান এবং সভ্যতা শব্দটিতে নগর অস্তিত্বের আভাস রয়েছে। স্বাধীনতার পরে, অন্যেরা হরপ্পাকে এর আদর্শ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে, হরপ্পা বা পরিণত হরপ্পা নামে নামকরণ করেন।
হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদড়োর কতোগুলো মৌলিক সাংস্কৃতিক চিহ্ন রয়েছে। পরবর্তীকালে অন্যান্য যেসব লোকালয় আবিস্কৃত হয়েছে, তারা ঐ সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত কিনা, সেটি ঐ চিহ্নের সংকেতে শনাক্ত করা যায়। [২] নির্ণায়ক বৈশিস্টহুলি নিচে তালিকাভুক্ত করা হলো
১। কুম্ভকারের চাকে প্রস্তুত বিভিন্ন মৃৎপাত্র: লাল পোড়ামাটিতে প্রস্তুত, স্থূল প্রাচীরযুক্ত ভারি, কখনো কখনো লাল রঙের প্রলেপ দেয়া। কয়েকটি পাত্র কালো রঙ করা; মৃৎপাত্রের গায়ে নির্দিষ্ট ধরনের কিছু জনপ্রিয় নকশা: যেমন, পিপুল পাতা, পরস্পরছেদী বৃত্ত এবং ময়ূর। [৩]
২। সিন্ধুলিপি, বিশেষভাবে সীলমোহরে দৃষ্ট, বিশিস্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, স্থানিক ভিন্নতার প্রভাবমুক্ত। [৪]
৩। পোড়ানো ইট, সেইসঙ্গে রোদে পোড়া কাদামাটির ইট, আয়তন, ত্রিমাত্রিক অনুপাত ১:২:৪। [৫]
৪। ১৩.৬৩ গ্রাম এককের ভিত্তিতে আপাতভাবে আদর্শ ভর। [৬]
৫। শহর ও শহরতলীর জনবসতিতে সোজা পথ তৈরির প্রবণতা (রাস্তাগুলো পরস্পরকে সমকোণে ছেদ করেছে) এবং নিকাশী ব্যবস্থায় বেশি মনোযোগ। এছাড়াও শহর সংলগ্ন এবং পৃথক স্থানে নগরদূর্গ নির্মাণ। [৭]
স্বাভাবিক ভাবেই উপরের সব কয়টি বৈশিষ্ট্য প্রতিটি জনপদে দেখা যাবে এমন আশা করা যায় না। বিশেষত ক্ষুদ্র জনবসতির ক্ষেত্রে, কিংবা যেখানে কোনো খননকার্য হয়নি সেখানে তো নয়ই। সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত জনবসতিগুলো পাকিস্তানের সমতলভূমিতে এবং বেলুচিস্তানে, ভারতের অন্তর্গত পাঞ্জাব প্রদেশে, হারিয়ানায়, উত্তর পশ্চিমে উত্তরপ্রদেশে, উত্তর রাজস্থান এবং গুজরাটে আবিস্কৃত হয়েছে। [৮]
[সম্পাদনা] সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার এবং জনসংখ্যা
আধুনিক আঞ্চলিক সীমারেখার সংজ্ঞায়, সিন্ধু সভ্যতা পাঞ্জাবের অধিকাংশ অঞ্চল (ভারতীয় প্রজাতন্ত্র এবং পাকিস্তান উভয় দেশের), হারিয়ানা, উত্তর রাজস্থান এবং পশ্চিম উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অংশ, সিন্ধু, গুজরাটের অধিকাংশ এবং উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিণ বেলুচিস্তানের কয়েকটি স্থানে বিস্তৃত ছিলো। বাস্তব অপরিহার্যতায় এটি ছিলো সমতলের সংস্কৃতি। মান্ডা (জম্মু ও কাশ্মীর) এবং রূপার ও চণ্ডীগড়ে (পাঞ্জাব)এর ক্ষেত্র দ্বারা চিহ্নিত নিন্ম হিমালয়ের পাদদেশ রেখা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো, কিন্তু কখনোই ঐ সীমা অতিক্রম করেনি। উত্তর পশ্চিম পাঞ্জাবের লবণাক্ত অঞ্চলে কিংবা সিন্ধু এলাকা অতিক্রম করে উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশের সিন্ধু-উত্তর পর্বতমালায়, যেখানে কোটদিজি সংস্কৃতি পুষ্ট এবং বর্ধিত হয়েছে, সেখানে সিন্ধু সভ্যতার কোনো একটি অঞ্চলেরও সন্ধান মেলেনি। উত্তর পূর্ব বেলুচিস্তানে সুলাইমান অঞ্চলের ঝোব উপত্যকায় অবস্থিত পেরিয়ানো ঘুন্দাইকে সীমান্তবর্তী একটি বিছিন্ন স্থান বলে মনে হয়। কিন্তু মালভূমি প্রাচীরের ঠিক উচুতে দাবারকোট সহ বোলান গিরিপথের নিচে বেলুচিস্তানের পাহাড় অতিক্রম করে ইরান- পাকিস্তানের সীমানার নিকটে দাশত নদীর তীরবর্তী সুতকাজেন ডোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। পরিণত সিন্ধু সভ্যতার স্মৃতিচিহ্নে সমৃদ্ধ ছিলো কচ্ছ্ব; আর গুজরাটের নাগেশ্বর অঞ্চল।[৯] এ বিশাল অঞ্চলে (প্রায় ৭,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার) কতো লোক বসবাস করতো, নানাভাবে তার সংখ্যার হিসেব করা হয়েছে আর সেই হিসেব ১০ লক্ষে পৌছেছে। এদের মাঝামাঝি কোনো সংখ্যা ধরে নেয়াটাই ভালো।[১০] তবে অন্য একটি হিসেবও পাওয়া গেছে। সিন্ধু অঞ্চলের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষে পৌছোয়, অর্থাৎ প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ছয় জন মানুষ।[১১]
[সম্পাদনা] কৃষি ও জীবিকা
একথা অনস্বীকার্য যে, নাগরিক বিপ্লবের জন্য কৃষি উৎপাদনের পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রসারণ প্রয়োজন। সিন্ধু উপত্যকায় কোনো বিশেষ কারণ ছিলো, যা এ ধরনের প্রসারে অভূতপূর্ব সহযোগিতা করোছিলো। বলা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৫১০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২২৩০, এ সময়কালে আজকের তুলনায় অত্যন্ত বেশি বৃষি্টপাত হওয়ায়, সে অঞ্চলে দীর্ঘকাল আর্দ্র পর্ব স্থায়ী হয়েছিলো। পরিবেশের এ সহায়তার কারণে সিন্ধু উপত্যকায় পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ের তুলনায় সে সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিলো। তবে কৃষিক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়, ওই সময়কার কৃষি হাতিয়ার। প্রাচীন সিন্ধু সংস্কৃতির সময়কালে লাঙলের উপস্থিতিই তার একমাত্র প্রমাণ নয়, বরং বানাওয়ালি এবং জাওয়াইওয়ালায় (বাহাওয়ালপুর) কাদামাটির লাঙল আবিষ্কারও একই সূত্রে গৎথা। উত্তরপূর্ব আফগানিস্তানে শোরতুঘাই এর সিন্ধু জনবসতিতে লাঙল-কর্ষিত ভূক্ষেত্র পাওয়া গেছে। লাঙল আসার পরে উৎপাদন ক্ষমতার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হলেও, ফসল কাটার জন্য তেমন কোনো যন্ত্রপাতি সেসময়ের ইতিহাস থেকে জানা যায় না।[১২]
ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে সঞ্চিত ভৌমজলকে যেসব প্রাচীন সভ্যতায় কূপের সাহায্যে সংরক্ষিত করা হতো, তাদের মধ্যে প্রথম যে সভ্যতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে, তা হলো সিন্ধু সভ্যতা। গ্রামেও যে কাচা ইদারা খনন করা হতো, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। আর আল্লাহডিনো (করাচীর নিকটে)তে উচ্চতর ভূমিতে নির্মিত এক পাথরে বাধানো কূপও রয়েছে। সম্ভবত নিচের ভূক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য এটি উচুতে স্থাপন করা হয়েছে। তবে সেখানে পুলি ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
প্রাচীন এবং পরিণত সিন্ধু এলাকাসমূহে খেজুর, বদরী (ber), আঙুর এবং আনারস উৎপাদিত হবার প্রমাণ (বীজের স্বাক্ষ্য) পাওয়া গেছে। প্রথম দুটি মেহরগড়ের প্রাচীনতম বসতিস্তরে পাওয়া গেছে। পরের দুটি হেলমন্দ উপত্যকায় উৎপাদিত হতো। আবিস্কৃত প্রাণী অস্থির মধ্যে "জেবু"র সন্তানসন্ততিদের হাড়ের সংখ্যা অত্যাধিক। বলদ গাড়ি এবং লাঙল টানতো এবং গরু দুধ দিতো, এতেই বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সিন্ধু এলাকার মানুষজনের জীবনযাত্রার স্বর্ণইতিহাস। এছাড়া সিন্ধু এলাকার জনগণের অন্যতম পেশা ছিলো শিকার। সিন্ধু সীল মোহর দেখে একটি বিষয় বলা যায় যে, বন্য এবং হিংস্র পশুর মোকাবেলা করা তখনকার সময়ের মানুষদের মধ্যে একটি অন্যতম বিষয় হিসেবে প্রতিভাত হয়।
[সম্পাদনা] তথ্যসূত্র
- ↑ John Marshal (ed) Mohenjodaro And The Indus- Valley Civilization, London, 1931, Page: 112
- ↑ Wallbank and Taylor, Cililization- Past & Present, Page: 118
- ↑ The Entire Racial History of India Is Obscure, IBID, Page: 85
- ↑ রামশরণ শর্মা, প্রাচীন ভারত (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কোলকাতা, ১৯৮৯), পৃষ্ঠা: ২৬-২৭
- ↑ R.C.Majumder, History of Ancient Bengal, Calcutta, 1974, Pagr: 17-18
- ↑ আনিসুজ্জামান, স্বরূপের সন্ধানে (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৭৬), পৃষ্ঠা: ২৫
- ↑ Gordon Child, Man Makes Himself, London, 1936, Chapter: 7
- ↑ অতুল সুর, বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, কোলকাতা, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা: ২৫
- ↑ অতুল সুর, বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, কোলকাতা, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা: ১২৮-১২৯
- ↑ Posehoole, The Indus Age: The Beginnings, Volume:2, Page: 1001
- ↑ Martima Huiller, Archaeology From The Earth, Oxford, 1954, Page: 669
- ↑ Devid R. Harish, The Origins and Spread of Agriculture and Pastoralism in Eurasia, London, 1996, Page: 332-346
[সম্পাদনা] বহিঃসংযোগ
- Harrapa and Indus Valley Civilisation at harrapa.com
- An invitation to the Indus Civilisation (Tokyo Metropolitan Museum)
- The Harappan Civilisation
- The Homeland of Indo-European Languages and Culture: Some Thoughts By B.B. Lal
- The Indus-Sarasvati Civilization Essay by Michel Danino
- Indus Artifacts
- Indus-Sarasvati Resources Index
- Sarasvati-Sindhu Civilisation
- Cache of Seal Impressions Discovered in Western India