অতীশ দীপঙ্কর
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অতীশ দীপঙ্কর ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মুগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত।
অতীশ দীপঙ্কর গৌড়ীয় রাজ পরিবারে রাজা কল্যাণশ্রী ও প্রভাবতীর মধ্যম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ।
আদিনাথ প্রথমে নিজের মায়ের কাছে এবং পরে সে সময়ের প্রখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত অবধূত জেতারির কাছে তিনি পাঁচটি অপ্রধান বিজ্ঞানে বিদ্যালাভ করেন। তিনি ত্রিপিটক ভৈবাষিক দর্শন ও তান্ত্রিক শাস্ত্রে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন। ওদন্তপুরী বিহারের জ্ঞানী ভীক্ষু রাহুল গুপ্ত তাকে "গুহ্যজ্ঞান ব্রজ" পদবীতে ভূষিত করেন। ওদন্তপুরী বিহারের মহাসঙ্ঘিকাচার্য শীল রক্ষিত তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন এবং তাঁর নতুন নাম দেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ১০১১ সালে তিনি শতাধিক শিষ্যসহ মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে যান এবং সেখানে প্রখ্যাত আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে ১২ বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ৪৪ বছর বয়সে তিনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন।
ভারতবর্ষে ফেরার পর ১৫ বছর ধরে তিনি ওদন্তপুরী ও সোমপুরী বিহারে অধ্যাপক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গদেশের রাজা প্রথম মহীপালের অনুরোধে বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। তিব্বতের রাজা হ্লা-লামা তাঁকে স্বর্ণ উপহার দিয়ে সেখানে ধর্ম প্রচারের আহ্বান জানান, কিন্তু দীপঙ্কর তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিব্বতের পরবর্তী রাজা চ্যান-চাব জ্ঞানপ্রভ তাঁকে পুনরায় আমন্ত্রণ করলে তিনি ১০৪১ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে যাত্রা শুরু করে দুর্গম হিমালয় পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে তিব্বতে যান। পথে নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। নেপালের রাজপুত্র পথপ্রভা তাঁর কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন।
তিব্বতে পৌঁছে দীপঙ্কর রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেন। এখনও সেখানকার মঠের প্রাচীরে এই সংবর্ধনার দৃশ্য আঁকা আছে। তিনি সেখানে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা ও কারিগরিবিদ্যা সম্পর্কে তিব্বতি ভাষায় দুইশ'রও বেশি বই রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তিব্বতবাসীদের মাঝে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিব্বতবাসীরা গৌতম বুদ্ধের পরেই তাঁকে স্থান দেয় এবং তাঁকে 'জোবো ছেনপো' বা মহাপ্রভুরূপে মান্য করে। তারা তাঁকে "অতীশ" উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি তিব্বতে বহু প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি আবিষ্কার করেন এবং নিজ হাতে সেগুলির প্রতিলিপি করে বাংলায় পাঠান।
অতীতের তিব্বতের যেকোন আলোচনাতেই অতীশ দীপঙ্কর ঘুরে ফিরে আসেন। তিনি তিব্বতের ধর্ম, ইতিহাস, রাজকাহিনী, জীবনীগ্রন্থ, ও স্তোত্রনামা লেখেন। তাঁর মূল সংস্কৃত রচনাগুলি বর্তমানে বিলুপ্ত। তিনি তাঞ্জুর' নামের বিশাল তিব্বতি শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। এই মহাগ্রন্থে দীপঙ্করের ৭৯টি গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ আছে।
১৩ বছর তিব্বতে বাস করার পর ১০৫৪ সালে বাহাত্তর বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরীর অদূরে ঞেথাং বিহারে অতীশ দীপঙ্কর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৮শে জুন তাঁর পবিত্র দেহভস্ম চীন থেকে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে অনীত হয় এবং সেখানে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।