লুৎফর রহমান
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ডাঃ লুৎফর রহমান (১৮৯৭ - ১৯৩৬) একজন বাংলাদেশী সাহিত্যিক ও মানবতাবাদী। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি মুসলিম সমাজে যে রেনেসার সূচনা হয়েছিলো ডাঃ লুৎফর রহমান তার বিশিষ্ট চিন্তানায়ক ছিলেন।
সূচিপত্র |
[সম্পাদনা] পরিবার
জন্ম ১৮৯৭ সালে যশোর জেলার (বর্তমান [[মাগুরা জেলা) পারনান্দুয়ালী গ্রামে, মাতামহ মুনশী গোলাম কাদেরের গৃহে। পৈতৃক আবাস ছিলো মাগুরা জেলার হাজিপুর গ্রামে। তার পিতার নাম জরদার মইনুদ্দীন আহমদ, মাতা শামনূর নাহার। তাদের চার পুত্র ও এক কন্যা ছিলো। লুৎফর রহমানের পিতা ছিলেন এন্ট্রান্স পাশ। তিনি স্টেশন মাস্টারের চাকরি করতেন। ইংরেজি ভাষা ও এর সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ ছিলো। সম্ভবত পিতার থেকেই এ অনুরাগ লুৎফর রহমান এর মাঝে এসেছিলো। তার মাতা ছিলেন একজন বিদূষী নারী। এঁর দ্বারা লুৎফর রহমান তার চারিত্রিক গঠনে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এফ.এ পাঠকালে আয়শা খাতুন এর প্রতি প্রণয়াসক্ত হন এবং তাকে বিয়ে করেন। আয়শা খাতুনের পিতা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন এ সময়ে মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ে বুকিং ক্লার্ক ছিলেন।
[সম্পাদনা] শিক্ষাজীবন
লুৎফর রহমান এর শিক্ষাজীবনের সূচনা নিজ গ্রাম হাজিপুরের নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি মাগুরা শহরে মাগুরা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯১৫ সালে এন্ট্রান্স পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। হুগলী মহসিন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। কলকাতায় টেলর হোস্টেলে থাকাকালীন তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তার আগ্রহ কমতে থাকে এবং এফ.এ পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ১৯২১ সালে কৃষ্ণনগর হোমিওপ্যাথিক কলেজ থেকে এইচ.এম.বি ডিগ্রী লাভ করেন।
[সম্পাদনা] কর্মজীবন
এফ.এ পাঠকালেই ১৯১৬ সালে লুৎফর রহমান সিরাজগঞ্জে ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে এংলো পারসিয়ান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। তবে এ বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও তিনি পাঠদান করতেন। স্কুল কতৃপক্ষের সাথে মতান্তরের কারণে এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি চট্টগ্রাম জোরারগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে কলকাতায় তিনি হোমিওপ্যাথিক মতে চিকিৎসা শুরু করেন। সম্ভবত ১৯২৫-২৬ সালের দিকে অত্যধিক শারিরীক ও মানসিক পরিশ্রমে এবং অভাব অনটনের কারণে তার শরীর ভেঙ্গে পড়ে।
এক সময় তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। সকলের সেবা পরিচর্যায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে হাজিপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জনৈকা সন্নাসিনীর প্রদত্ত ওষুধে অনেকটা রোগমুক্ত হন। কবিরাজী ওষুধের শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তিনি এর নামকরণ করেন যোগিনী পাচন। সুস্থ হয়ে পার্শ্ববর্তী মির্জাপুর গ্রামে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আরম্ভ করেন। এসময় তিনি কয়েকটি পেটেন্ট ওষুধ বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। এগুলোর মধ্যে যোগিনী পাচন, আনন্দ বটিকা, জ্বরবিজয়ী বটিকা, নয়ন শান্তি, মুখারি, ক্ষত-শান্তি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি চিকিৎসক হিসেবে সুনাম অর্জন করলেও স্থানীয় একজন চিকিৎসকের ষড়যন্ত্রে অতিষ্ঠ হয়ে মির্জাপুর থেকে চলে যান। পরে মাগুরা স্টিমারঘাট সংলগ্ন একটি বাড়িতে ডাক্তারখানা খুলেছিলেন। ১৯৩১ সালে তিনি আবার নিজগ্রাম হাজিপুরে ফিরে আসেন এবং সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
[সম্পাদনা] সাহিত্যিক জীবন
লুৎফর রহমান মুক্তবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তার সাহিত্যেও এ মতসমূহের প্রভাব পড়ত। ১৯২০ সালে তিনি সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবার ব্রত নিয়ে কলকাতা যান। এ সময় অসহযোগ আন্দোলনের প্রাক্কালে তিনি বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। নভেম্বর মাসের তৃতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা থেকে তিনি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (পরে ডক্টরেট প্রাপ্ত) ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা এর প্রকাশ ভার গ্রহণ করেন।
লুৎফর রহমানের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল মূলত কবিতা রচনার মাধ্যমে। পরে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ, কিছুসংখ্যক উপন্যাস, কিছু শিশুতোষ সাহিত্য, ছোটো গল্প, কথিকা ইত্যাদি রচনা করেন। মানবিক সুকুমার বৃত্তিগুলোর উপর তার রচনা অসংখ্য। তার কিছু অনুবাদ কর্মও পাওয়া যায়। তৎকালীন বাংলা ভাষার বিখ্যাত পত্রিকা ও সাময়িকীগুলোতে তার রচনা সমূহ প্রকাশ হত যা পরে একত্রে সঙ্কলিত হয়েছে। বিশেষত সওগাত, প্রবাসী, হিতবাদী, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, মোসলেম ভারত, সাধনা, সোলতান, সহচর, সাম্যবাদী, সাহিত্যিক, মোয়াজ্জিন, মাসিক মোহাম্মদী প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রিকায় তার সাহিত্যকর্ম গুলো প্রকাশ হত।
[সম্পাদনা] চিন্তাধারা ও কর্ম
লুৎফর রহমান বিশ্বাস করতেন, মানুষের শক্তির প্রধাণ উৎস হচ্ছে জ্ঞান এবং জীবনের সুন্দর বিশুদ্ধতম অনুভূতির নাম হচ্ছে প্রেম। উন্নত জীবন দর্শন মেনে চলতেন। লোকদেখানো এবং বংশগত সম্মানকে তিনি গ্রহণ করেননি। নামের সাথে তিনি কখনো নিজ কৌলিক উপাধি জরদার ব্যবহার করতেন না। এ সম্বন্ধে উচ্চজীবন গ্রন্থের পিতৃমাতৃভক্তি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
“ |
প্রবন্ধ লেখকের বংশকে লোকে জরদার-বংশ বলে থাকেন। জরদার অর্থ স্বর্ণ অথবা ধন-সম্পত্তির মালিক। বড়লোক ছাড়া কারো এই উপাধি হয় না। নদীয়া জেলার এক ব্রাহ্মণের এ উপাধি আছে; সুতরাং এ উপাধি ব্যবহার করতে মনে গর্ব ছাড়া লজ্জা আসে না। কিন্তু বিবেকের কাছে অনুমতি চাইলে সে জিজ্ঞাসা করেছে তোমার অর্থ কই? আর অর্থ যদিই থাকে, তবে তা লোকের কাছে প্রচার করা কী প্রকার ভদ্রতা? |
” |
সমাজসেবার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন লুৎফর রহমান। পথভ্রষ্ট ও সমাজ পরিত্যক্ত নারীদের সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে নিজ আবাসস্থলেই গড়ে তোলেন নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের সভানেত্রী ছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এবং সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজেই। এছাড়াও কবি খান মোহাম্মদ মইনুদ্দীন ও মোহাম্মদ জোবেদ আলী কার্যনির্বাহী পরিষদের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
[সম্পাদনা] মৃত্যু
১৯৩৬ সালে ৩১ মার্চ (১৮ চৈত্র, ১৩৪২ বঙ্গাব্দ) যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে ডাঃ লুৎফর রহমান নিজগ্রাম হাজিপুরেই মৃত্যুবরন করেন।
[সম্পাদনা] সাহিত্যকর্ম
[সম্পাদনা] প্রবন্ধ
- উন্নত জীবন
- মহৎ জীবন
- উচ্চ জীবন
- মানব জীবন
- ধর্ম জীবন
- মহা জীবন
- যুবক জীবন
[সম্পাদনা] উপন্যাস
- বাসর উপহার
- রানী-হেলেন
- প্রীতি উপহার
- রায়হান
- পথহারা
[সম্পাদনা] ছোটোগল্প
পলায়ন, রানী, অহিংসা, রাজপথ, অমাবস্যা, রোমান্টিক বিয়ে, ফিরে যাও-ফিরে যাও
[সম্পাদনা] কাব্য গ্রন্থ
- প্রকাশ
[সম্পাদনা] অনুবাদ সাহিত্য
- মঙ্গল ভবিষ্যৎ
- দুঃখের রাত্রি (লা মিজারেবল এর অনুবাদ)
- মুসলমান
[সম্পাদনা] তথ্যসূত্র
- ডা. লুৎফর রহমান রচনাসমগ্র- সালিম সাবরিন সম্পাদিত।