আফগানিস্তানের ভূগোল
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আফগানিস্তান এশিয়া মহাদেশের কেন্দ্রে, ইরানীয় মালভূমির ওপর অবস্থিত একটি দেশ। দেশটির আয়তন ৬৪৭,৫০০ বর্গকিলোমিটার। দেশটি স্থলবেষ্টিত ও পর্বতময়। হিন্দু কুশ পর্বতমালার অধিকাংশই এই দেশে অবস্থিত। দেশটিতে চারটি প্রধান নদী আছে: আমু দরিয়া, হারি রুদ, কাবুল নদী এবং হেলমন্দ নদী।
আফগানিস্তানের উত্তর সীমানায় তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান; পূর্বে চীন এবং পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর; দক্ষিণে পাকিস্তান এবং পশ্চিমে ইরান।
দেশটির আয়তন ৬৫২,২২৫ বর্গ কিমি (২৫১,৮২৫ বর্গমাইল)। পূর্ব-পশ্চিমে এর সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১,২৪০ কিমি (৭৭০ মাইল); উত্তর-দক্ষিণে সর্বোচ্চ ১,০১৫ কিমি (৬৩০ মাইল)। উত্তর-পশ্চিম, পশ্চিম ও দক্ষিণের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি মূলত মরুভূমি ও পর্বতশ্রেণী। উত্তর-পূর্বে দেশটি ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে হিমবাহ-আবৃত পশ্চিম হিমালয়ের হিন্দুকুশ পর্বতের সাথে মিশে গেছে। আমু দরিয়া নদী ও এর উপনদী পাঞ্জ দেশটির উত্তর সীমান্ত নির্ধারণ করেছে।
আফগানিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চল সুউচ্চ পর্বতময় এলাকা। দেশটির প্রায় অর্ধেক এলাকার উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২,০০০ মিটার বা তার চেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। ছোট ছোট হিমবাহ ও বছরব্যাপী তুষারক্ষেত্র প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ৭,৪৮৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট নওশাক আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এটি পাকিস্তানের তিরিচ মির পর্বতশৃঙ্গের একটি নিচু পার্শ্বশাখা। পর্বতটি আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বে হিন্দুকুশ পর্বতমালার অংশ, যেটি আবার পামির মালভূমির দক্ষিণে অবস্থিত। হিন্দুকুশ থেকে অন্যান্য নীচু পর্বতসারি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে প্রধান শাখাটি দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রসারিত হয়ে পশ্চিমের ইরান সীমান্ত অবধি চলে গেছে। এই নিচু পর্বতমালাগুলির মধ্যে রয়েছে পারোপামিসুস পর্বতমালা, যা উত্তর আফগানিস্তান অতিক্রম করেছে, এবং সফেদ কোহ পর্বতমালা, যা পাকিস্তানের সাথে পূর্ব সীমান্ত তৈরি করেছে। সফেকদ কোহ-তেই রয়েছে বিখ্যাত খাইবার পাস, যা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে সংযুক্তকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ। অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমিগুলি দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমে অবস্থিত। এদের মধ্যে রয়েছে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের হেরাত-ফেরা নিম্নভূমি, দক্ষিণ-পশ্চিমের সিস্তান ও হেলমন্দ নদী অববাহিকা, এবং দক্ষিণের রিগেস্তান মরুভূমি।
নদী উপত্যকাগুলি ও আরও কিছু ভূগর্ভস্থ পানিবিশিষ্ট নিম্নভূমি ছাড়া অন্য কোথাও কৃষিকাজ হয় না বললেই চলে। মাত্র ১২ শতাংশ এলাকা পশু চারণযোগ্য। দেশটির মাত্র ১ শতাংশ এলাকা বনাঞ্চল, এবং এগুলি মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানে অবস্থিত। যুদ্ধ ও জ্বালানি সংকটের কারণে বনভূমি দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
আফগানিস্তান এত পর্বতময় যে এগুলির মধ্যকার রাস্তাগুলি দেশটির বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার কুশান পাসের ভেতর দিয়ে এসে দেশটি আক্রমণ করেন এবং খাইবার পাস দিয়ে বের হয়ে গিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। এই একই পথ ধরে মোঘল সম্রাট বাবর ১৫শ শতকে এসে আফগানিস্তান ও ভারত দুই-ই করায়ত্ত করেন। অন্যদিকে সোভিয়েতরা সালাং পাস ও কেন্দ্রীয় হিন্দুকুশে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখল করে।
সূচিপত্র |
[সম্পাদনা] নদী ও জলাশয়
আফগানিস্তানের বেশির ভাগ প্রধান নদীর উৎপত্তি পার্বত্য জলধারা থেকে। দীর্ঘস্থায়ী শুষ্ক মৌসুমে বেশির ভাগ নদী শীর্ণ ধারায় প্রবাহিত হয়। বসন্তে পর্বতের বরফ গলা শুরু হলে এগুলিতে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। বেশির ভাগ নদীই হ্রদ, জলাভূমি কিংবা নোনাভূমিতে পতিত হয়। এদের মধ্যে কাবুল নদী ব্যতিক্রম; এটি পূর্বে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানের সিন্ধু নদের সাথে মেশে, যা পরে ভারত মহাসাগরে গিয়ে পতিত হয়। দেশটির একমাত্র নৌ-পরিবহনযোগ্য নদীটি হল উত্তর সীমান্তের আমু দরিয়া। তবে ফেরি নৌকার সাহায্যে অন্যান্য নদীর গভীর এলাকায় যাওয়া যায়। পামির মালভূমি থেকে উৎপন্ন পাঞ্জ ও বখ্শ্ উপনদী থেকে পানি আমু দরিয়ায় গিয়ে মেশে। হারিরুদ নদী মধ্য আফগানিস্তানে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে ইরানের সাথে সীমান্ত সৃষ্টি করেছে। হারিরুদের পানি হেরাত অঞ্চলে সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। হেলমান্দ নদী কেন্দ্রীয় হিন্দুকুশ পর্বতমালায় উৎপন্ন হয়ে দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ইরানে প্রবেশ করেছে। এই নদীটি ব্যাপকভাবে সেচকাজে ব্যবহৃত হয়, তবে ইদানিং এর পানিতে খনিজ লবনের আধিক্য দেখা যাওয়ায় শস্যে পানি দেয়ার কাজে এর উপযোগিতা কমে এসেছে।
আফগানিস্তানের হ্রদগুলি সংখ্যায় ও আকারে ছোট। এদের মধ্যে আছে তাজিকিস্তান সীমান্তে ওয়াখান করিডোরে অবস্থিত জার্কোল হ্রদ, বাদাখশানে অবস্থিত শিভেহ হ্রদ, এবং গজনীর দক্ষিণে অবস্থিত লবণাক্ত হ্রদ ইস্তাদেহ-ইয়ে মোকোর। সিস্তান হ্রদ বা হামুন-ই-হেলমান্দ হেলমান্দ নদীর শেষসীমায় লবণাক্ত জলা এলাকায় ইরানের সীমান্তে অবস্থিত। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কিছু কিছু নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এদের মধ্যে আছে কাবুল শহরের পূর্বে কাবুল নদীর উপরে নির্মিত সারোবি ও নাগলু বাঁধ, হেলমান্দ নদীর উপর নির্মিত কাজাকি জলাধার, এবং কান্দাহার শহরের কাছে হেলমান্দ নদীর একটি উপনদীর উপর নির্মিত আর্গান্দাব বাঁধ।
[সম্পাদনা] প্রাণী ও জীবজন্ত
আফগানিস্তানের উদ্ভিদরাজি সংখ্যায় অল্প কিন্তু বিচিত্র। পর্বতে চিরসবুজ বন, ওক, পপলার, হেজেলনাট ঝাড়, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম ইত্যাদি দেখা যায়। উত্তরের সমতলভূমি মূলত শুষ্ক, বৃক্ষহীন ঘাসভূমি, আর দক্ষিণ-পশ্চিমের সমভূমি বসবাসের অযোগ্য মরুভূমি। শুষ্ক অঞ্চলের গাছের মধ্যে আছে ক্যামেল থর্ন, লোকোউইড, মিমোসা, ওয়ার্মউড, সেজব্রাশ, ইত্যাদি। আফগানিস্তানের বন্য এলাকায় দেখতে পাওয়া প্রাণীর মধ্যে আছে আর্গালি (মার্কো পোলো ভেড়া নামেও পরিচিত), উরিয়াল (মাঝারি আকারের বন্য ভেড়া), আইবেক্স বা বুনো ছাগল, ভালুক, নেকড়ে, শেয়াল, হায়েনা ও বেঁজি। এছাড়াও বন্য শূকর, শজারু, ছুঁচা, বন্য খরগোশ, বাদুড় এবং অনেক তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণী (rodents) দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কিছু কিছু স্তন্যপায়ী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন গ্যাজেল হরিণ, চিতা, বরফ চিতা, মার্কর ছাগল, এবং বাকত্রীয় হরিণ। আফগানিস্তানে প্রায় ২০০ জাতের পাখিরও দেখা মেলে। ফ্লেমিংগো ও অন্যান্য জলচর পাখি গজনীর উত্তরে ও দক্ষিণে হ্রদ এলাকায় দেখতে পাওয়া যায়। হাঁস ও তিতিরজাতীয় পাখিও চোখে পড়ে। তবে পাখি অনেক শিকার করা হয় এবং ফলে কিছু কিছু পাখির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন, যেমন - সাইবেরীয় বক।
[সম্পাদনা] জলবায়ু
আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকাতেই অধঃ-সুমেরুদেশীয় পার্বত্য জলবায়ু বিদ্যমান। এখানে শীতকাল শুষ্ক। নিম্নভূমিতে জলবায়ু ঊষর ও অর্ধ-ঊষর। পর্বতগুলিতে ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী কিছু উপত্যকায় মৌসুমী বায়ু নিরক্ষদেশীয় সামুদ্রিক ভেজা বাতাস বহন করে নিয়ে আসে। আফগানিস্তানে মূলত দুইটি ঋতু। গরম গ্রীষ্মকাল এবং অত্যন্ত শীতল শীতকাল। উত্তরের উপত্যকায় ৪৯° সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা গ্রীষ্মে রেকর্ড করা হয়েছে। শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে হিন্দুকুশ ও আশেপাশের ২০০০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট অঞ্চলে তাপমাত্রা -৯° সেলসিয়াসে নেমে পড়ে। অন্যান্য উঁচু এলাকায় উচ্চতাভেদে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটে।
এমনকি একই দিনে তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য ঘটতে পারে। বরফজমা ভোর থেকে দুপুরে ৩৫° তাপমাত্রা ওঠা বিচিত্র নয়। অক্টোবর ও এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টিপাত হয়। মরুভূমি এলাকায় বছরে ৪ ইঞ্চিরও কম বৃষ্টি পড়ে। অন্যদিকে পর্বত এলাকায় বছরে জলপাতের পরিমাণ ৪০ ইঞ্চিরও বেশি, তবে এর বেশির ভাগই তুষারপাত। পশ্চিমের হাওয়া মাঝে মাঝে বিরাট ধূলিঝড়ের সৃষ্টি করে, আর সূর্যের উত্তাপে স্থানীয় ঘূর্ণিবায়ু ওঠাও সাধারণ ঘটনা।
[সম্পাদনা] প্রাকৃতিক সম্পদ
আফগানিস্তানে ছোট আকারে মণি, সোনা, তামা ও কয়লা উত্তোলনের ইতিহাস থাকলেও প্রণালীবদ্ধভাবে খনিজ আহরণ ১৯৬০-এর দশকের আগে শুরু হয়নি। ১৯৭০-এর দশকে দেশটির উত্তরাঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাসের উল্লেখযোগ্য রিজার্ভ আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া পেট্রোলিয়াম ও কয়লাও এখানে পাওয়া যায়। দেশটিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তামা, লোহা, বেরাইট, ক্রোমাইট, সীসা, দস্তা, গন্ধক, লবন ও অভ্রের মজুত আছে। বহু শতাব্দী ধরে আফগানিস্তান দুষ্প্রাপ্য ও অর্ধ-দুষ্প্রাপ্য পাথরের উৎসস্থল, যাদের মধ্যে আছে নীলকান্তমণি, চুনি, নীলা ও পান্না।
[সম্পাদনা] আরও দেখুন
|
---|
আজারবাইজান • আফগানিস্তান • ইন্দোনেশিয়া • ইয়েমেন • ইরাক • ইরান • ইসরায়েল • উজবেকিস্তান • উত্তর কোরিয়া • ওমান • ক্যাম্বোডিয়া • কুয়েত • কাজাকিস্তান • কাতার • কিরগিজিস্তান • চীন • জর্ডান • জাপান • তুর্কমেনিস্তান • তুরস্ক • তাজিকিস্তান • থাইল্যান্ড • দক্ষিণ কোরিয়া • নেপাল • পূর্ব তিমুর • পাকিস্তান • ফিলিপাইন • ব্রুনাই • বাংলাদেশ • বাহরাইন • ভুটান • ভারত • ভিয়েতনাম • মঙ্গোলিয়া • মায়ানমার • মালদ্বীপ • মালয়েশিয়া • লাওস • লেবানন • শ্রীলংকা • সংযুক্ত আরব আমিরাত • সাইপ্রাস • সিঙ্গাপুর • সিরিয়া • সৌদি আরব |